শ্রী শ্রী সন্তোষী মাতার ব্রতকথা 

শ্রী শ্রী সন্তোষী মাতার ব্রতকথা | Santoshi mata vratkatha Bangla

সময় বা কাল- প্রত্যেক শুক্রবার স্নান করে শুদ্ধাচারে সন্তোষী মাতার পুজো করার নিয়ম। পুজোর সময় চারদিকে ভাল করে ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে দেবে। সন্তোষী মাতার পুজোর জন্য কোনো তিথি নক্ষত্র মেনে ব্রত করার দরকার হয় না।

ব্রতের দ্রব্য ও বিধান- ছোলা, গুড়, ফল, ছানা, ছোলার ডাল, শাক, মিষ্ট দ্রব্য প্রভৃতি সাধ্যমত আয়োজন করা প্রয়োজন। পুজোর ব্রতকথা শুনে বা নিজে পড়ে প্রসাদ বিতরণ আর এয়োদের মাথায় সিঁদূর পরিয়ে নিজে সিঁদূর পরতে হয়। ছোলা আর গুড় হাতে নিয়ে ব্রতকথা শুনতে বা পড়তে হয়। এই দিন টক খাওয়া নিষেধ। পুজো শেষে বালক ভোজন করানো কর্তব্য।

পুজোর নিয়ম- শুদ্ধ কাপড় পরে পূর্ব বা উত্তর মুখে বসে “নমঃ বিষ্ণু” বলে তিনবার মুখে গঙ্গাজল দিয়ে আচমন করতে হয়। “নমো অপবিত্র পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোহপি বা। যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তর শুচিঃ” এই মন্ত্র বলে জল হাতে নিয়ে মাথায় জলের ছিটা দিতে হবে।

পুষ্পশুদ্ধি – ফুল স্পর্শ করে বলতে হবে-“ওম্ পুষ্পে পুষ্পে মহাপুষ্পে সুপুষ্পে পুষ্পসম্ভবে। পুষ্প চয়াবকীর্ণে চ হুং ফট্ স্বাহা।”

জলশুদ্ধি- কোশাতে জল রেখে “ওম্ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি। নর্মদে সিন্ধুকাবেরি জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুবু। কুরুক্ষেত্র গয়া গঙ্গা প্রভাস পুষ্করাণি চ। পূণ্যান্যেতানি তীর্থানি পূজাকালে ভবস্তিহ”-এই মন্ত্র পাঠ করবে।

আসনশুদ্ধি-“অস্য আসন মন্ত্রস্য মেরুপৃষ্ঠঋষিঃ সুতলং ছন্দঃ কুৰ্ম্মোদেবতা আসনোপবেশনে বিনিয়োগঃ।” পরে কৃতাঞ্জলি হয়ে, “ও পৃথ্বী ত্বয়া ধৃতা লোকা দেবী ত্বং বিষ্ণুনা ধৃতা। তঞ্চ ধারয় মাং নিত্যং পবিত্রং কুরু চাসনম্। বামে গুরুভ্যো নমঃ, দক্ষিণে গণেশায় নমঃ, উর্দ্ধে ব্রহ্মণে নমঃ, অধঃ অনন্তায় নমঃ, সম্মুখে সন্তোষী মাতায় নমঃ।”

সঙ্কল্প- কুশীতে হরিতকী ও জল রেখে হাতে ধরে থাকবে আর (মাস, পক্ষ, তিথি এবং ব্রতীর নাম করে) বলবে-“বিষ্ণুঃওস্তৎসদদ্য অমুকে মাসি, অমুকে পক্ষে, অমুকতিথেী, অমুকগোত্রায়াঃ, শ্রীঅমুকদেব্যাঃ দাস্যাঃ বা সর্ব্বাপচ্ছাপ্তি মনোগতসম্ভীষ্টসিদ্ধিকামা শ্রীসন্তোষীমাতৃপূজা কর্মাহং করিষ্যে।” এই কথা বলার পর কুশী মাটিতে রাখবে। তার পর হাত যোড় করে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের মনের বাসনার কথা বলতে হবে। এরপর প্রণাম করে ব্রতকথা শুনবে।

সন্তোষী মাতার ব্রতকথা- এক বুড়ী আর তার সাত ছেলে ছিল। সাত ছেলের মধ্যে ছ’জন কাজকর্ম করত আর ছোট ছেলে রামলাল ছিল বেকার, ভাইদের গলগ্রহ। বুড়ী রোজ ভাল ভাল রান্না করে রোজগেরে ছেলে আর তাদের বৌদের পেট ভরে খাওয়াতো এবং সকলের খাওয়ার শেষে এঁটো খাবার যা পড়ে থাকতো, সেই সব রামলাল আর তার বৌ সাবিত্রীকে খেতে দিত। সাবিত্রী এই ব্যাপার নিজে জানতো কিন্তু রামলাল এসব কথা জানত না।

একদিন কথায় কথায় রামলাল তার বৌকে বলল, “জানো, মা আমাদের কত ভালোবাসেন। আমি কোনো কাজকর্ম করি না, তবুও তিনি তোমাকে আর আমাকে ঠিক মত খেতে-পরতে দেন।” ছোটবৌ তখন আর চুপ করে থাকতে পারল না, কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে সব কথা খুলে বলে ফেলল। রামলাল শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেল-সে বলল, “মা সবাইকার পাতের উচ্ছিষ্ট আমাদের খেতে দেয়, এটা তো আমি জানতুম না। ঠিক আছে, সব যখন শুনলুম, তখন এবার আমি এদিকে লক্ষ্য রাখব।”

বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন তাদের বাড়িতে খুব ভাল ভাল রান্না হয়েছিল। রামলাল লুকিয়ে থেকে সব দেখবার জন্যে ঘরের কোণে কাপড় মুড়ি দিয়ে অসুখের ভাণ করে পড়ে রইল। তার মাকে বলল যে, আমার মাথার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি পরে খাবো। কাপড়ের একটু ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল যে, তার মা ছয় ছেলে ও তাদের বৌদের ডেকে বেশ আদর-যত্ন করে খেতে দিলেন। তারা খেয়ে উঠে গেলে পাতে যেসব উচ্ছিষ্ট পড়েছিল সেগুলো সব একত্র জড়ো করে দু’ভাগে ভাগ করে তাদের দু’জনের জন্যে তুলে রেখে দিলেন।

রামলাল মার এই ব্যবহার দেখে মনে খুব দুঃখ পেল, সেদিন সে আর কিছু খেল না। পরের দিন সকালে সে মাকে গিয়ে বলল, “মা! আমি বিদেশে যাবো ঠিক করেছি। এখানে তো কোনো কাজকর্ম জুটলো না, বিদেশে গিয়ে দেখি যদি কিছু সুবিধে হয়।” বুড়ী বলল, “সেই ভাল, ঘরে বসে অন্ন ধ্বংস করার চেয়ে বিদেশে গিয়ে কাজের চেষ্টা করা অনেক ভাল।” বুড়ী সহজেই রাজী হয়ে গেল দেখে রামলাল তার বৌকেও সেই কথা বলে তারও মত নিয়ে নিল। সাবিত্রী ভালভাবেই জানতো যে, স্বামীকে ছেড়ে থাকলে তার কষ্ট আরও অনেক বেড়ে যাবে, তাকে আরও বেশী লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হবে; কিন্তু এছাড়া তার কোন উপায়ও ছিল না।

তিন দিন হাঁটবার পর রামলাল একটা শহরে গিয়ে উপস্থিত হল। অনেক জায়গায় একটা চাকরির জন্যে ঘোরাঘুরি করার পর এক সওদাগরের কাছে তার খাওয়াপরা সুদ্ধ পাঁচ টাকা মাইনের একটা চাকরি জুটল। রামলাল নিজের বুদ্ধি আর সততার গুণে খুব শীঘ্রই সওদাগরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো, এমন কি কিছুদিনের মধ্যে সওদাগর তাকে বারবারের অর্ধেক অংশীদার করে দিলেন। এদিকে বাড়িতে সাবিত্রীর ওপর অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন আরও বেড়ে চলল। আগে সে সকলের উচ্ছিষ্ট খেতে পেত, এখন শুধু পায় গমের ভুষির রুটি, আনাজের খোসা সেদ্ধ আর নুন লঙ্কা। তবু সাবিত্রী ভগবানের ওপর অচলা-বিশ্বাস নিয়ে কেবল বলতে লাগল, “ঠাকুর। আমাদের সুদিন দাও।”

একদিন বনের ভেতর কাঠ কুড়াতে কুড়াতে ক্লান্ত হয়ে সে একটা মন্দিরের দরজার সামনে বসে বিশ্রাম করছিল। সেদিন ছিল শুক্রবার, মন্দিরে পুজো হচ্ছিল। সাবিত্রী একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, “এখানে কোন ঠাকুরের পুজো হচ্ছে?” লোকটি বলল, “দেবী সন্তোষী মাতার পুজো হচ্ছে, ইনি হচ্ছেন সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশের মানস- কন্যা।” সাবিত্রী জিজ্ঞাসা করল, “এই দেবীর পুজো করলে কী হয়?” লোকটি বলল, “যার যা মনস্কামনা সব পূর্ণ হয়, আর সব দুঃখও ঘুচে যায়।” সাবিত্রী তখন বলল, “আমি যদি এই ব্রত ও পুজো করতে চাই তাহলে করতে পারব?”

লোকটি বলল নিশ্চয়ই পারবে, তুমি কি আজ উপোস করে আছ?” সাবিত্রী বলল, “হ্যাঁ, আমি আজ সকাল থেকে একটু জলও খাইনি।” লোকটি বলল, ‘তবে তো ভালই হল, তুমি গুড আর ছোলা হাতে নিয়ে বস, ভক্তি করে দেবীর ব্রতকথা শোনো, পরে ‘সন্তোষীমাতার জয়’ বলে মাকে প্রণাম কর। আর এখন থেকে প্রত্যেক শুক্রবারে মায়ের পুজো করবে, তাহলে তোমার সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হবে। পুজোর দিন তোমার ক্ষমতা মত দেবীকে ছানা, মিষ্টি, ফল, ছোলার ডাল, শাক, ছোলা, গুড় আর নিরামিষ খাবার দিয়ে ভোগ দেবে।

শেষে পারলে বালক ভোজন আর ব্রাহ্মণ ভোজনও করাবে। তোমার সাধ্যমত ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দেবে, তাহলেই তোমার ব্রত উদযাপন করা হবে। তবে সাবধান! ওই দিনে নিজেও টক খাবে না আর অন্য কারুকেও টক খেতে দেবে না।” সাবিত্রী সেদিন তার কথামত সন্তোষী মাতার ব্রত পালন করল। পরে প্রত্যেক দিনই বনে কাঠ কুড়াতে গিয়ে মন্দিরে আসতো আর ব্যাকুল হয়ে দেবী সন্তোষী মাতার কাছে প্রার্থনা করে বলত, “মা। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে এনে দাও মা।”

সাবিত্রীর কাতর প্রার্থনায় দেবী একদিন সেই দূরদেশে রামলালকে স্বপ্ন দিয়ে তার স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দিলেন। রামলাল বলল, “মা! আমি কেমন করে বাড়ী যাব, আমাকে যে রোজই দোকানে বসতে হয়।” দেবী বললেন, “কাল তুই আমাকে ‘স্মরণ করে দোকানে বসবি, তাহলে তোর দোকানের সব মাল বিক্রি হয়ে যাবে।” ঠিক তাই হল। রামলাল তখন দেবীকে প্রণাম করে দোকান বন্ধ করে দিয়ে সেই দিনই বাড়ির দিকে রওনা হল। রামলালকে দেশে ফিরতে দেখে সাবিত্রীর আনন্দ আর ধরে না। অল্প দিনের মধ্যে সে প্রচুর ধনের অধিকারী হয়ে উঠল। রামলাল সেই গ্রামেই একটা বাড়ি তৈরি করে সাবিত্রীকে নিয়ে সেখানে উঠে গেল। নতুন বাড়িতে গিয়ে সাবিত্রী খুব ঘটা করে সন্তোষী মায়ের ব্রত উদ্যাপন করল।

বালক ভোজনের জন্য গাঁয়ের অন্য সব ছেলেদের সঙ্গে সে তার ভাসুরদের ছেলে-মেয়েদেরও নেমন্তন্ন করল। এদিকে সাবিত্রীর সুখ-সম্পদ দেখে তার জায়েরা হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছিল। তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের শিখিয়ে দিল, “কাকীমার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নিবি, আর সেই পয়সায় কোন টক জিনিস কিনে খাবি।”

খাওয়ার শেষে ভাসুরের ছেলে-মেয়েরা কাকীমার কাছে পয়সার জন্য আবদার করতে লাগল, কাকীমাও সরল মনে তাদের কিছু কিছু পয়সা দিল। সেই পয়সায় ভাসুরপো-ভাসুরঝিরা টক কিনে খুব মজা করে খেল। তারা টক খাওয়ায় সন্তোমী মা খুব রেগে গেলেন। এদিকে রামলালের হঠাৎ অবস্থার এই পরিবর্তন দেখে দেশের জমিদারের তার ওপর সন্দেহ হল, আর রামলালের ছয় ভাই আর তাদের বৌ-এরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যে করে নানা রকম কুৎসা রটনা করল।তখন জমিদারের লোকেরা এসে রামলালকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার ওপর খুব অত্যাচার করতে লাগল।

সাবিত্রী তখন সন্তোষী মাতার মন্দিরে গিয়ে মার কাছে কেঁদে পড়ল, সে স্বামীর মুক্তির জন্য আকুল হয়ে মার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল। এতে তার উপর মার দয়া হল, তিনি এই দুর্বিপাকের কারণ সব জানিয়ে বললেন, “কখনো ছোট ছেলেদের হাতে পয়সা দিবি না-ফল বা মিষ্টি দিবি। যা আবার আমার ব্রত কর, তাহলে তোর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সাবিত্রী মায়ের আদেশ মত তাই করল। দেবীর কৃপায় জমিদার নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, বিদেশে লোক পাঠিয়েও রামলালের উন্নতির প্রমাণ পেলেন। তখন তিনি রামলালকে সম্মানের সঙ্গে মুক্তি দিয়ে তার টাকা কড়ি ও সব সম্পত্তি (যা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন) ফেরৎ দিলেন। এরপর দেবীব দয়ায় সাবিত্রীর একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হল, রামলালের কারবারও দিন দিন বাড়তে লাগল।

ছেলে বড় হলে সুন্দরী মেয়ে দেখে রামলাল তার বিয়ে দিল। সাবিত্রী ছেলের বৌকে শিখিয়ে দিল কী ভাবে সন্তোষীমার ব্রত করতে হয়। গ্রামের অন্য অন্য সব মেয়ে-বৌরাও এই ব্রত করতে শিখল। শেষে সংসার, ছেলে-বৌ-এর হাতে তুলে দিয়ে রামলাল আর সাবিত্রী স্বার্গে চলে গেল।

আমাদের এই পোস্ট টি ভাল লাগলে অন্যদেরকে শেয়ার করতে পারেন। আমরা সম্পূর্ণ ফ্রী তে হিন্দু ধর্মের মন্ত্র স্তোত্রম ব্রতকথা ইত্যাদি হিন্দু ধর্মের পূজা অর্চনা শেখানোর চেষ্টা করছি। আপনি আমাদের কে কিছু অর্থনৈতিক সাহায্য করলে আমরা আপনার কাছে বাধিত থাকিবএখানে ক্লিক করুন।

আরও পড়ুন – চৈত্র মাসের ব্রতকথা

Join Bharatsastra Telegram channelJoin Whatsapp bharatsastra

Leave a Comment