নাটাই চণ্ডীর ব্রত – Natai chandi brata
নাটাই চণ্ডীর ব্রতএর সঠিক সময় বা কাল—অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি রবিবার সন্ধ্যের সময় প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধুনো দিয়ে ষোড়শোপচারে নাটাই চণ্ডীর পুজো করতে হয়।
নাটাই চণ্ডীর ব্রতের দ্রব্য ও বিধান—ষোড়শোপচারে পুজো করার জন্যে পুজোর সব জিনিস যোগাড় করতে হবে। এই ব্রতে সমস্ত দিন উপোস করে থেকে রাত্তিরে পুজোর পর ব্রতকথা শুনতে হবে ও তারপর ফল, মিষ্টি ও দুধ খেয়ে কাটাতে হবে।
নাটাই চণ্ডীর ব্রতের ব্রতকথা-এক দেশে এক সওদাগর তার স্ত্রী, একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে নিয়ে বাস করত। সে বেশ মনের আনন্দেই সংসার করছিল, এমনি সময়ে হঠাৎ তার স্ত্রী মারা গেল। সওদাগর তখন তার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিজে মানুষ করতে পারবে না ভেবে—আবার বিয়ে করল।
সওদাগরের নতুন স্ত্রী এল বটে, কিন্তু সওদাগরের ছেলে-মেয়ের এতে কোনো সুবিধে হল না-সৎ মা তাদের মোটেই দেখতে পারত না—কেবল তাদের ওপর অত্যাচারই করতে লাগল। সওদাগর সবই দেখল, কিন্তু তার স্ত্রীকে কিছু বলতে পারল না। এইভাবে কিছুদিন কেটে যাবার পর সওদাগর দেখল যে, এবার বাণিজ্যে বের হওয়া দরকার কারণ বসে বসে আর কতদিন চলতে পারে।
কিন্তু তার খুব ভাবনা হল ছেলে-মেয়ে দুটোর জন্যে। সে বেশ বুঝতে পারল যে, তার স্ত্রী ওদের ভাল করে খেতে না দিয়ে শুকিয়ে মারবে—অথচ তারও বাণিজ্যে না গেলেই নয়। তখন সে স্থির করল যে, তার ছেলে-মেয়ে বাড়িতেই থাকুক আর তাদের একটু ভাল করে খাওয়া-দাওয়া যাতে হয় তার জন্যে সে তার বন্ধু এক ময়রা আর একজন গয়লাকে গিয়ে বলল, “ভাই, বাণিজ্যে যাবো, আমার ছেলে-মেয়ে দুটো এখানে রইল। তারা যখন যা খেতে চাইবে তোমরা তাদের তাই খেতে দিও।
আমি বাণিজ্য থেকে ফিরে এসে তোমাদের দাম সব শোধ করে দেবো।” ময়রা আর গয়লা সওদাগরের কথায় রাজী হয়ে গেল। সওদাগর তখন তার ছেলে-মেয়েকেও বলে দিল যে, তাদের ক্ষিদে পেলে তারা যেন ময়রা আর গয়লা, কাছ থেকে খাবার নিয়ে যায়, খাবারের দাম সে ফিরে এসে দেবে। এই ব্যবস্থা করে সওদাগর বাণিজ্যে রওনা হয়ে গেল। সওদাগর বাণিজ্যে বেরিয়ে যাবার পর তার স্ত্রী তার সতীনের ছেলে-মেয়ের ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। তাদের পেট ভরে খেতে তো দিতই না, উপরন্তু খুব ঘাটাতে লাগল তাদের।
গরু নিয়ে তাদের রোজ মাঠে চরাতে পাঠিয়ে দিত, কিন্তু তারা সন্ধ্যের সময় ফিরলে তাদের পেট ভরে খেতে দিত না। তবুও ছেলে-মেয়ের শরীর খারাপ হওয়ার বদলে ভাল হচ্ছে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল যে, ব্যাপার কী? তার নিজের ছেলেরাও তখন একটু বড় হয়ে ছিল। তাই একদিন ওদের গরু চরাতে যাবার সময় নিজের ছেলেদেরও তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল।
সওাগরের ছেলে-মেয়ে যেমন ময়রা আর গয়লার কাছ থেকে খাবার নিয়ে খায়,তেমনি খেয়ে তারা মাঠে গরু চরাতে চলে গেল। সন্ধ্যের সময় সবাই বাড়ি ফিরলে, সওদাগরের স্ত্রী নিজের ছেলেদের মুখ থেকে জানলো যে, তার সতীনের ছেলে-মেয়ে কোথা থেকে খাবার নিয়ে যায়। সে তখন ময়রা ও গয়লাকে ডেকে বলে দিল যে, কর্তা খবর দিয়ে জানিয়েছেন যে, বাণিজ্যে তাঁর বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না, তারা তাঁর ছেলে-মেয়েকে এবার আর যেন না দেয়।
এতে ময়রা আর গয়লা ভাবল, কর্তা যখন বারণ করেছেন তখন ওদের আর খাবার দেওয়ার দরকার নেই। খাবার না পাওয়ার দরুণ ছেলে-মেয়ে দুটো দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। একদিন তারা গরুগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে একটা অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় গিয়ে বসেছিল, একটু পরে তাদের ঘুমে চোখ বুজে এল, তারা ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলে ঘুম ভাঙ্গতে তারা দেখল যে, একটা গরুও মাঠে নেই। তখন তাদের খুব ভয় হল। কিছু দূরে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে তারা সেই বাড়িতে গিয়ে তাদের গরু হারানোর কথা জানালো।
বাড়ির গিন্নী তাদের কথা শুনে বললেন, “তোমাদের কোন ভয় নেই। তোমরা আমাদের বাড়িতে আজ থাকো, আমার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তোমরাও আজ নাটাই চণ্ডীর পুজো কর, তোমাদের তাহলে কোনো কষ্ট থাকবে না।” এই কথা শুনে সওদাগরের ছেলে-মেয়েও, নাটাই চণ্ডীর ব্রত করল। গিন্নী বললেন, “এবার তোমরা বর চাও, যা চাইবে মা চণ্ডী তাই দেবেন।” ছেলে-মেয়ে দুটো ভয়ে ভয়ে বলল, “মা! আমাদের গরুগুলো যেন ফিরে আসে।” গিন্নী বললেন, “গরু তো ফিরে আসবেই, তোমরা অন্য কোন বর চাও। তোমরা এই বর চাও যে—তোমাদের বাবা যেন শিগ্গির বাণিজ্য থেকে বাড়ী ফিরে আসেন।
সঙ্গে নৌকো ভর্তি সোনা-দানা -” তারপর তিনি সওদাগরের ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার জন্যে একটি সুন্দর টুকটুকে বউ আর তোমার বোনের জন্যে রাজপুত্তুরের মত একটা যেন জামাই নিয়ে আসেন।” গিন্নীর কথামতো তারা সেই বরই চাইল। পরের দিন গিন্নী তাদের বেশ ভাল করে খাইয়ে-দাইয়ে মাঠে পাঠিয়ে দিলেন। তারা মাঠে এসে দেখল যে, গরুগুলো বেশ আনন্দে চরে বেড়াচ্ছে এবং ঘাস খাচ্ছে। এরই মধ্যে সওদাগরও অনেক ধন-সম্পদ আর বউ-জামাই নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িতে এসে ছেলে-মেয়েকে দেখতে পেলেন না। স্ত্রীর মুখে শুনলেন যে, গতকাল থেকে তারা বাড়িতে আসেনি। তাদের কোনো খোঁজ-খবরও পাওয়া যাচ্ছে না।
এই কথা শুনে সওদাগর তখুনি ছেলে-মেয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী ভাবল যে—এইবেলা সমস্ত সোনা-দানা আর সবকিছু একটা গর্তে পুঁতে রাখি, কেউ যাতে জানতে না পারে। এই কথা ভেবে সে বাড়ির কাছে একটা কুয়ো দেখতে গিয়ে তার মধ্যে পড়ে মরে গেল। সওদাগর ছেলে-মেয়ের খোঁজে মাঠে গিয়ে দেখলেন যে তারা গরু চরাচ্ছে। তখন তিনি তাদের সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন।
বাড়িতে এসে সওদাগর দেখলেন, সোনা-দানা, ধন-দৌলত সব চারিদিকে ছড়ানো পড়ে রয়েছে আর স্ত্রীকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। স্ত্রীকে খুঁজতে গিয়ে সওদাগর দেখলেন যে, তাঁর স্ত্রী কুয়োর মধ্যে পড়ে রয়েছে। সওদাগর তাকে তুলে বাঁচাবার জন্যে অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে বাঁচলো না। তখন সওদাগর তাঁর ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাই নিয়ে সুখে ঘর করতে লাগলেন।
ব্রতের ফল—নাটাই চণ্ডীর ব্রত করার ফলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর হয় আর বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন কেটে যায়।
পড়তে থাকুন – অগ্রহায়ণ মাসের ব্রতকথা
ভারতশাস্ত্র এর সমস্ত আপডেট এখন টেলিগ্রামে পেয়ে যাবেন (Join Telegram)
Share with others:
- Click to share on X (Opens in new window) X
- Click to share on Facebook (Opens in new window) Facebook
- Click to share on Pinterest (Opens in new window) Pinterest
- Click to share on Telegram (Opens in new window) Telegram
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window) WhatsApp
- Click to email a link to a friend (Opens in new window) Email
- More