কার্ত্তিক মাসের যম পুকুর ব্রত
যম পুকুর ব্রতের সময় বা কাল— এই ব্রত মেয়েদের করতে হয় সকালবেলায়, আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত। চার বছর পরে ব্রতের উদ্যাপন করতে হয়।
যম পুকুর ব্রতের দ্রব্য ও বিধান— উঠোনে একটি ছোট পুকুর কেটে তার মধ্যে, কচু, হলুদ, কলমী, শুষনী ও হিংচে গাছ পুঁততে হবে এবং পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে,
মাটির যমরাজা ও যমরাণী, যমের পিসিকে বসাবে। উত্তর পাড়ে মেছো ও মেছুনী, পূর্ব পাড়ে ধোপা ও ধোপানী আর পশ্চিম পাড়ে বসাতে হবে—কাক, বক, চিল, কুমীর ও কচ্ছপ ইত্যাদি।
প্রতি পাড়ে, একটা করে হলুদ, সুপুরি আর কড়ি পোতার নিয়ম আছে। এরপর পূর্বমুখে বসে মন্ত্র বলে পুজো করা কর্তব্য। চার কাহন কড়ি ও দক্ষিণা উদযাপনের সময় দিতে হয়।
পুকুরের জল দেবার ছড়া
রাজার বেটা পক্ষী মারে
শুষনী কলমী ল’ ল’ করে। মারণ পক্ষী শুকোয় বিল।
খিল খুলতে লাগলো ছড়
সোনার কৌটো রূপোর খিল। আমার বাপ-ভাই (বা স্বামী) হোক
লক্ষেশ্বর ॥
গাছে জল দেবার ছড়া
কালো কচু সাদা কচু ল’ ল’ করে। খিল খুলতে লাগলো ছড়
রাজার বেটা পক্ষী মারে।
আমার বাপ-ভাই হোক লক্ষেশ্বর
লক্ষ লক্ষ দিলে বর।
ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর ।।
পুতুল পুজোর ছড়া
(এক একটি হাতে ধরে ফুলে দেবে)
যম রাজা সাক্ষী থাকো যম রাণী সাক্ষী থাকো
যম পুকুরটি পূজি। যম পুকুরটি পূজি
এই ভাবে পর পর সমস্ত পুতুলের পুজো করে পুকুরে এক একবার জল দেবে আর মন্ত্র বলবেন।
এক ঘটি জল আমি দিই বাপ-মার।
এক ঘটি জল দিই শ্বশুর-শাশুড়ীর ।
এক ঘটি জল দিই পাড়া-পড়শীর।
শেষ ঘটি জল দিই আমার স্বামীর ।
সাত ভায়ের বোন আমি ভাগ্যবতী। যম পুকুর পূজি আমি সাক্ষী জগৎপতি।
যম পুকুর ব্রতকথা— যমের বুড়ী শাশুড়ী, যমের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে খুব কষ্ট ও অশাস্তি ভোগ করতে লাগল। তখন তার একটি মাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে, ঘরে সুন্দরী বউ নিয়ে এল।
বউটি কাজে কর্মে খুবই লক্ষ্মীমন্ত ছিল। হলে কী হবে, যমের ওপর থেকে কিছুতেই বুড়ীর রাগ পড়ল না। – তার প্রধান কারণ হল যে, যম বুড়ীর মেয়েকে এক বছর বিয়ে হয়ে গেলেও কিছুতেই তাকে তার বাপের বাড়িতে আসতে দিচ্ছিলেন না।
এদিকে বউ এসে, আশ্বিন সংক্রান্তির দিন, বাড়ির উঠোনে একটা ছোট পুকুর কাটিয়ে যম পুকুর ব্রত করার ব্যবস্থা করল। শাশুড়ী যখন জানতে পারল যে, বউ যমের ব্রত করছে, তখন ব্রতের সব জিনিস লাথি মেরে ভেঙ্গেচুরে নষ্ট করে দিল।
বউ কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না — সে যমকে ডেকে বলল, হে ধর্মরাজ যম। প্রথম বছর আমি তোমার ব্রত করার ব্যবস্থা করলুম, আর আমার শাশুড়ী এসে সব নষ্ট করে দিল, তুমি এর সাক্ষী থেকো।”
পরের বছরেও এই দিনে বউ লুকিয়ে পুকুর ধারে এত করছে, শাশুড়ী জানতে পেরেই ছুটে এসে আবার লাথি মেরে সব ভেঙ্গে নষ্ট করে দিল। এবারেও বউ যমকে সাক্ষী করে রাখল।
Yama Pukur Vrat | Yama Puja
তৃতীয় বছরেও বউ রান্নাঘরের উনুনের ভেতর সব লুকিয়ে রেখে যখন লুকিয়ে ব্রত করছিল তখনও বুড়ী জানতে পারল আর সব নষ্ট করে দিয়ে বউকে খুব মারধোর করল। বুড়ী বলল,
“তুই রান্নাঘরে লুকিয়ে বসে আমার সর্বনাশের ব্যবস্থা করছিস, তুই কি আমাকে আর আমার ছেলেকে খেতে চাস নাকি ?” এবারেও বউ খুব কাদতে কাদতে যমকে সাক্ষী করে রাখল।
চার বছরের বেলায় বউ বাগানে একটা কলাগাছের তলায় যখন ব্রত করছে অমনি বুড়ী ব্যাপারটা টের পেল আর বউকে খুব গালাগাল দিয়ে মারধোর করে আনার সব জিনিস নষ্ট করে দিল।
বউ তখন খুব কাঁদতে লাগল আর পুজো করতে না পারার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিল যম রাজাকে সাক্ষী রেখে। এইভাবে কিছুদিন যাবার পর বুড়ীর খুব শক্ত অসুখ করল – ছেলে অনেক চেষ্টা করেও বুড়ীকে বাচাতে পারল না
শেষ পর্যন্ত বুড়ী মারা গেল। মা মারা গেছে শুনে, বুড়ীর মেয়ে যমের বউ, খুব খানিকটা কান্নাকাটি করল। তারপর বাপের বাড়িতে এসে, মার শ্রাদ্ধ শান্তি করে আবার যমপুরীতে ফিরে গেল।
মায়ের জন্যে রাতদিন বউয়ের মন খারাপ দেখে যম তাকে বললেন, “তুমি রোজ একটু করে ইচ্ছেমত এদিক ওদিকে বেড়াবার চেষ্টা করো, তাহলে মনটা ক্রমেই ভাল হবে—তবে সব দিকেই যেতে পার দক্ষিণ দিকে মোটেই যেও না।”
যমের কথা মত যমের বউ এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করল। এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল যে, যমরাজ তাকে দক্ষিণ দিকে যেতে বারণ করেছেন।
কিন্তু কী আছে ওদিকে, একবার দেখতে দোষ কী। এই মনে করে যমের বউ দক্ষিণ দিকে কী আছে দেখতে গেল। সেখানে সে যা দেখল তাতে তার মাথা ঘুরে গেল।
যম পুকুর ব্রত | Yama Pukur Puja
সে দেখল যে নরকের মধ্যে একটা কৃমির কুণ্ড রয়েছে, আর তার মধ্যে অগণিত পাপীর দল নরকভোগ করছে আর যন্ত্রণায় চিৎকার করছে—তার ওপর যমদূতেরা ভয়ানক মুষল দিয়ে ক্রমাগত তাদের মাথায় মারছে।
তারই মধ্যে সে দেখল তার মাও সেই কুণ্ডের ভেতর রয়েছে আর যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে তার মেয়ের নাম ধরে তাকে রক্ষা করবার জন্যে বার বার বলছে।
যমের বউ এই দৃশ্য আর দেখতে পারল না, সে তাড়াতাড়ি যমপুরীতে ফিরে গেল, সে দুঃখে খুব প্রিয়মান হয়ে চুপ করে এক জায়গায় বসে রইল। যম তার স্ত্রীকে ওইভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে, তার কারণ জিজ্ঞাসা
করলেন। বউ তখন যমের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলল, “আমি তোমার বারণ না শুনে দক্ষিণ দিকে গিয়েছিলাম, সেখানে দেখলাম আমার মাও সেই নরকে পড়ে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করছে আর ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করছে— যেমন করেই হোক আমার মাকে তোমায় উদ্ধার করতেই হবে।”
যম তখন বললেন, “তোমার মা অনেক পাপ করেছে, তোমার ভাজের ওপর অকথ্য অত্যাচার করে তাকে মারধোর করেছে আর তার যম পুকুরের ব্রত নষ্ট করে দিয়ে আমায় খুবই অপমান করেছে— তাই তাকে এই শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে, সেই সব পাপের জন্যে।
তবে তার উদ্ধারের একটা মাত্র পথ আছে—আর তোমার ভাজই মনে করলে তার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু সে ‘শাশুড়ীর কাছ থেকে যে অত্যাচার আর লাঞ্ছনা ভোগ করেছে, সে তাতে রাজী হবে কিনা সন্দেহ।”
যমের বউ তখন যমকে কোনো একটা উপায় করে দেবার জন্যে খুবই অনুনয় বিনয় করতে লাগল। যম তখন বললেন, “বেশ, তবে একটা উপায় যদি করতে পার তাহলে তোমার মা উদ্ধার হতে পারে।
তোমার ভাজের এখন সন্তান হওয়ার সময় এসেছে—সন্তান প্রসবের সময় আমি তার ওপর ভর করব, তার সন্তান কিছুতেই প্রসব হবে না—সে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে।
সেই সময় যদি তুমি তোমার ভাজকে বুঝিয়ে রাজী করাতে পার যে, সে তোমার মায়ের নামে চারটে পুকুর কাটিয়ে আমার পুজো করবে তাহলে তার সন্তান প্রসব হতে দেরি হবে না। এইভাবে ব্রত করতে রাজী হলে তখুনি তার সস্তান প্রসব হবে।”
যমের বউ এই কথা শুনে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল – আর তার ভাজের প্রসব বেদনা হতেই তার মায়ের অর্থাৎ বউয়ের শাশুড়ীর নামে চারটে পুকুর কাটিয়ে যম পুকুর ব্রত করার জন্যে প্রতিজ্ঞা করতে বলল।
কিন্তু তার ভাজ প্রথমে কিছুতেই রাজী হল না–তার শাশুড়ীর অত্যাচারের কথা মনে করে। শেষে যখন যন্ত্রণা সহ্য করাও অসম্ভব হয়ে পড়ল– তখন সে কথা দিল যে, হ্যা, শাশুড়ীর নামে চারটে পুকুর কাটিয়ে সে যম পুকুর ব্রত করবে। কথা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হল।
আর তার শাশুড়ীও উদ্ধার হয়ে স্বর্গে চলে গেল। এই ঘটনার পর বাড়িতে খুব আনন্দ উৎসব হতে লাগল, সব দেখে শুনে যমের বউও তখন যমপুরীতে ফিরে গেল।
যম পুকুর ব্রতের ফল— এই ব্রত করলে মৃত্যু হওয়ার পর কোনো রকম নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না।
আরও পড়ুন – কার্তিকেয় ব্রত
ভারত শাস্ত্র এর সমস্ত আপডেট এখন টেলিগ্রামে পেয়ে যাবেন। এখনি যুক্ত হন আমাদের টেলিগ্রাম চ্য়ানেলে (Join Telegram)