দেবগুরু বৃহস্পতির কাহিনী

দেবগুরু বৃহস্পতি

দেবগুরু বৃহস্পতির কাহিনী

প্রাচীন কালে এক গরীব ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার কোনও সন্তান ছিল না। তার স্ত্রী সব সময় ময়লা বেশভূষা পরে থাকতো, স্নান করতো না, কোনও দেবতার পূজা বা ব্রতাদি করতো না।

সকালে উঠেই আগে যা খাবার পেতো খেতো। তার ফলে ব্রাহ্মণ খুবই দুঃখিত ছিলেন। স্ত্রীকে তিনি অনেক বলেও কিছু প্রতিকার করতে পারেন নি।

এই সময় ঈশ্বরের কৃপায় ব্রাহ্মণের একটি কন্যা হলো। দেখতে দেখতে মেয়েটি বড় হতে লাগলো । সে প্রতিদিন স্নান করে ঈশ্বরের আরাধনা করতো। তারপর সে বৃহস্পতিবার ব্রত করতে লাগলো।

দেবগুরু বৃহস্পতির কাহিনী

পূজা পাঠ সমাপ্ত করে কন্যাটি যখন পাঠশালায় যেতো, তখন একমুঠো যব হাতে করে নিয়ে যেত আর পথে ছড়াতে ছড়াতে যেতো। দেবতার কৃপায় সেই যব সোনা হয়ে যেতো।

পাঠশালা থেকে ফেরার পথে সেই সব সোনার যব ঐ কন্যাটি আঁচলে বেঁধে ঘরে আনতো।

একদিন সেই কন্যাটি সোনার যব দিয়ে পায়স রান্না করছিল। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ব্রাহ্মণ তাই দেখে বললে—মা, সোনার যবে কি পায়েস হয়?

বাবার কথা শুনে মেয়েটি মনে মনে বললে — হে বৃহস্পতিদেব! সোনার পায়েস দিয়ে তোমার পূজা দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু তা হলো না। আশ্চর্য ব্যাপার, মেয়েটি চিন্তা করবার সাথে সাথে সোনার পায়েস হয়ে গেল ।

তারপর থেকেই মেয়েটি রোজ সোনার যব পেতে লাগলো, তার ফলে দিনে দিনে সেই গরীব ব্রাহ্মণের অবস্থা ফিরতে লাগলো।

একদিন কন্যাটি সোনার যব পরিষ্কার করছিল, সেই সময় সেই দেশের রাজপুত্র ভ্রমণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণের কুটিরের সামনে এসে, ব্রাহ্মণ কন্যাকে সোনার যব পরিষ্কার করতে দেখে সে অবাক হয়ে গেল।

তারপর রাজপুত্র কাউকে কোন কথা না বলে ফিরে গেল প্রাসাদে, আর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে নিজের ঘরে শুনে রইলো চুপ করে।

রাজা-রানী এই সংবাদ পেয়ে রাজপুত্রের কাছে এসে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে রাজপুত্র বললে — বাবা, আপনার দয়ায় আমার কোনও দুঃখ নেই, কেউ আমাকে কটু কথাও বলেনি। কিন্তু রাজ্যের শেষপ্রান্তে আমি যে ব্রাহ্মণ কন্যাকে দেখে এসেছি তাকেই আমি বিবাহ করতে চাই। যে সোনার যব পরিষ্কার করছিল।

রাজপুত্রের কথা শুনে রাজা আশ্চর্য হয়ে বললেন – একি কখনও সম্ভব হয়? যদি তুমি আমাকে দেখাতে পারো, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, তারই সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব।

রাজপুত্র তখন সব বললে, রাজা সব শুনে মন্ত্রীকে পাঠালেন ব্রাহ্মণের কাছে। মন্ত্রী ব্রাহ্মণকে সব কথা বললেন। ব্রাহ্মণ আনন্দিত মনে রাজপুত্রের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তারপর শুভদিনে শুভক্ষণে রাজপুত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণ কন্যার বিবাহ হয়ে গেল।

বৃহস্পতি দেবের আরতী

কন্যাটি স্বামীর ঘরে যাবার পরই আবার ব্রাহ্মণের দুঃখ-দারিদ্র্য দেখা দিল। একদিন ব্রাহ্মণ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের মেয়ের কাছে গেল। মেয়ে বাপের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে দুঃখিত হলো

আর মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলো। তখন ব্রাহ্মণ তার স্ত্রীর কথা সব বললে । ব্রাহ্মণ কন্যা তখন অনেক অর্থ দিয়ে পিতাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।

সেই অর্থে ব্রাহ্মণের কিছুদিন সুখে কাটলো বটে, কিন্তু আবার দুঃখে পড়লো, তখন ব্রাহ্মণ আবার গেল মেয়ের কাছে। তাকে সব কথা বললে।

কন্যা সব কথা শুনে বললে – বাবা! আপনি মাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন। আমি তাকে বিধি-ব্যবস্থা সব বলে দেব, সেই সব মেনে চললে, দুঃখ-দারিদ্র্য আর থাকবে না।

মেয়ের কথা শুনে ব্রাহ্মণ তার স্ত্রীকে নিয়ে মেয়ের ঘরে গেলেন । মেয়ে মাকে বললে—মা, তুমি প্রাতঃকালে উঠে প্রথমে স্নানাদি করে শ্রীবিষ্ণু ভগবানের পূজা করলে, তোমার সব দুঃখ-কষ্ট দূর হবে। এই বলে মাকে কাছে রেখে দিল।

Brihaspati Devta

মা কিন্তু মেয়ের কথা না শুনে, সকালে উঠেই মেয়ের এঁটো খাবার খেয়ে নিলো। মায়ের ব্যবহারে মেয়ের খুব রাগ হলো। সে সব জিনিস পত্র একটা ঘরে বন্ধ করে রাখলো আর মাকে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখলো ৷

সকালে সে উঠে মাকে স্নানাদি করিয়ে পূজা পাঠ করালো, তার | ফলে মায়ের সুবুদ্ধি হলো এবং প্রতি বৃহস্পতিবার ব্রত করতে লাগলো।

এই ব্রতের প্রভাবে তার মা খুব ধনবতী হলো এবং পুত্রবর্তী হলো। দেবগুরু বৃহস্পতি দেবের কৃপায় সন্তানাদি সহ বহু সুখ ভোগ করে, পরলোকে স্বর্গে গেলেন।

এই ঘটনা দেখে এবং পুত্রবধূর কাছে ব্রতের কথা শুনে রাজাও বৃহস্পতিবার ব্রত করতে শুরু করলেন। ব্রতের প্রভাবে রাজার ধনৈশ্বর্য দিন দিন বেড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু রাজা দুবার ব্রত করতে ভুলে গেল।

তার ফলে বৃহস্পতিদের খুব রুষ্ট হলেন। তখন রাজার রাজত্বে নানারকম অভাব-অনটন দেখা দিল। একদিন রাজাকে বৃহস্পতিদের সব বললেন। রাজা তখন নগরে ঘোষণা করে দিলেন যে, আমার রাজ্যে | সকলে বৃহস্পতিবার ব্রত করবে।

এছাড়া আরও ঘোষণা করে দিলেন যে, | আমার প্রজারা আজ এই বৃহস্পতিবারে কেউ রান্না করবে না। ঘরে আগুন জ্বালাবে না। সকলেই আমার এখানেই আহার করবে। যদি কেউ আমার আজ্ঞা পালন না করে, তার মৃত্যুদণ্ড হবে।

রাজার আজ্ঞানুসারে সমস্ত প্রজা রাজবাড়ীতে খেতে এলো, কিন্তু একজন কাঠুরে খুব দেরীতে এলো। রাজা তাকে গোপনে নিয়ে গিয়ে পৃথক ঘরে আহার করাতে বসালেন।

সেই ঘরে রানীর মুক্তাহার ছিল। হঠাৎ সেটা পাওয়া গেল না। রানী ভাবলেন, এই লোকটাই মুক্তাহার চুরি করেছে। এই সন্দেহ করে কাঠুরিয়াকে বন্দী করে কারাগারে রাখা হলো।

এই কাঠুরিয়া ছিল একজন রাজা। দেবতার কোলে রাজ্যহারা হয়ে তাকে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছিল। যাই হোক, কাঠুরিয়া কারাগারে বন্দী হবার পর চিন্তা করতে লাগলো, কি জানি পূর্বজন্মে কি পাপ করেছিলাম। যার জন্যে এই শান্তি ভোগ করতে হচ্ছে।

ঠিক এই সময় দেবগুরু বৃহস্পতি সাধুর ছদ্মবেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে রাজাকে বললেন— ওরে মূর্খ। তুই বৃহস্পতি দেবতার কোপে এই দুঃখ পাচ্ছিস। যাক্ চিন্তা করিস না, বৃহস্পতিবার দিন তুই কারাগারের দরজায় কিছু পয়সা পাবি। তাই দিয়ে বৃহস্পতিদেবের পূজা করবি, তাহলেই তোর সব কষ্ট দূর হবে।

বৃহস্পতিবারে কারাগারের দরজায় বন্দী কিছু পয়সা পেল। সেই পয়সা দিয়ে বন্দী দেবগুরু বৃহস্পতিদেবের পূজা করলো। সেইদিনই রাত্রে সেই দেশের রাজাকে বৃহস্পতিদের স্বপ্ন দিয়ে বললেন –রাজা তুমি যাকে বন্দী করে রেখেছ, সে নির্দোষ। ওকে ছেড়ে দাও। রানীর হার রানীর ঘরে বিছানায় পড়ে আছে। যদি তুমি আমার আদেশ অমান্য করো, তাহলে আমি তোমার রাজ্য ধ্বংস করে দেব।

রাত্রে স্বপ্ন দেখে রাজ্য প্রাতঃকালে উঠে রানীর ঘরে হার পেরে গেল, এবং কারাগার থেকে কাঠুরিয়াকে মুক্ত করে এনে ক্ষমা চেয়ে, রাজার উপযুক্ত বসন ভূষণ দিলেন। তারপর অর্থ দিয়ে বিদায় দিলেন। রাজা বৃহস্পতিদেবকে স্মরণ করে কাঠুরিয়া বেশ ত্যাগ করে রাজবেশে নিজের রাজ্যের দিকে রওনা হলেন।

রাজ্যে ফিরে এসে রাজা খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। চারদিকে নতুন নতুন ধর্মশালা, মন্দির, পুকুর, সরোবর, কুয়া, বাগান গড়ে উঠেছে। চারদিক যেন ঝলমল করছে। রাজা জিজ্ঞাসা করে জানলেন রানী, এই সব করেছেন।

শুনে রাজার রাগ হলো। তিনি প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই সময় রাজার পুরাতন চাকরটি বাইরে ছিল, সে রাজাকে দেখেই চিনতে পারলো আর রানীকে সংবাদ দিল। রানী এসে রাজাকে

অভ্যর্থনা করে অন্তঃপুরে নিয়ে গেল। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন—এত ঐশ্বর্য তুমি কোথায় পেলে?

রানী বললেন—মহারাজ! আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। আমি বৃহস্পতিবার ব্রত করতাম বলে আপনি আমাকে কত ঠাট্টা করতেন। এমন কি একদিন আপনি রাগে আমার ব্রতের জিনিসপত্র নষ্ট করে দিয়েছিলেন।

তারপর থেকেই আমাদের রাজ্যে নানা রকম অমঙ্গল দেখা দেয়। মড়ক লাগে, রাজভাণ্ডার অর্থশূন্য হয়, অন্নাভাব দেখা দেয়। আপনি ক্ষুধার জ্বালায় প্রাসাদ ত্যাগ করে চলে যান, দাস-দাসীরাও চলে যায়।

আমি নিরুপায় হয়ে দেবগুরু বৃহস্পতি দেবের শরণাপন্ন হয়ে পড়ে থাকি। কতদিন অনাহারে, আধপেটা খেয়ে কেটেছে তার ঠিক নেই, তারপর দেবগুরু বৃহস্পতি দেবের কাছে তোমার কথা জানাই, তিনি স্বপ্নে বলেন—তোর স্বামী এখন কাঠুরিয়া পল্লীতে আছে পাশের রাজ্যে, আর কাঠ কেটে কোনরকমে

জীবিকা নির্বাহ করছে। তবে তুই চিন্তা করবি না। সে খুব শীঘ্র আসবে। তাঁরই দয়ায় আমি এতদিন রাজ্য পরিচালনা করেছি। তাঁরই দয়ায় আজ এত ধনৈশ্বর্য। প্রজারা সকলেই সুখী। তাই বলছি মহারাজ! আপনি | বৃহস্পতিবার ব্রত করুন।

রানীর কথায় রাজা জ্ঞান হলো, তিনি বুঝলেন দেবগুরু বৃহস্পতির | কোপেই একদিন তাকে রাজ্য ত্যাগ করতে হয়েছিল, রানীর পুণ্যেই সে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে।

রাজা আর কিছু বলতে পারলেন না। সেই বৃহস্পতিবার থেকে রাজা রাজ-পুরোহিতকে এনে বৃহস্পতিবার ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন। গরীব দুঃখীদের অর্থ, অন্ন, বস্ত্র দান করা হতে লাগলো । ধীরে ধীরে রাজা ইন্দ্রতুল্য হয়ে পড়লেন।

সেই থেকে মর্ত্যলোকে বৃহস্পতিবার ব্রত প্রচারিত হলো।

জয় বৃহস্পতিদেব কী জয়।

জয় শ্রীবিষ্ণু ভগবান কী জয়।।

আরও পড়ুন – মহাভারতের গান্ধারীর একশ জন পুত্রের নাম

শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম

ভারতশাস্ত্র এর সমস্ত আপডেট এখন টেলিগ্রামে পেয়ে যাবেন (Join Telegram)

Scroll to Top
Saraswati Puja top 5 Mantra Durga puja 2023 full panchang Top 5 Chants of Maa Durga Top 5 Ganesh Mantra for Ganesh Chaturthi Radha Krishna: দেখুন শ্রী রাধা কৃষ্ণের অপূর্ব রূপ